অভিষেক সেনগুপ্ত প্রাচুর্য ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। সাফল্যের ভরা জোয়ারে দাঁড়িয়ে। তবু তারকা সুলভ হাসির দেখা নেই!একফালি ঘরে খাটটা ফেলার পর হাঁটার বিশেষ জায়গা নেই। এক কোণে কাঠের ছোট্ট টেবল। তার উপর ভক্তদের বিচারে মাসের সেরা ফুটবলার হওয়ার দুটো ফলক পরম যত্নে রাখা। আর এক কোণে একটা ড্রেসিং টেবিল। জানালা ঘেঁষা খাটটাকে চৌকি বলাই ভালো। দুটো মলিন বালিশ ও একটা পাশবালিশ এলোমেলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাপোষা ছবি। আই লিগের দুটো বড় ম্যাচে পর পর গোল করে যিনি হইচই ফেলে দিয়েছেন, ভেঙে ফেলেছেন বেশ কিছু রেকর্ড, সেই জবি জাস্টিনের ডেরা এটাই। করুণাময়ী হাউজিং এস্টেটের সি-নাইন অ্যাপার্টমেন্টের চারতলার জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে। আর তাতে তিনি বেশ আলুথালু। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন দুপুরে। সমুদ্র ঘেঁষা তিরুবনন্তপুরমের প্রত্যন্ত গ্রাম ভেট্টুকুড়ের মৎস্যজীবী পরিবারের ছেলে কি আচমকা পাল্টে যাওয়া জীবনে একটু থমকে গিয়েছেন? হতেও পারে। সোমবার বিকেলে হাসতে হাসতে জবি বললেন, 'সত্যিই আমি এত কিছু ভাবিনি। আগের ডার্বিতে গোল করার পর সবাই অভিনন্দন জানিয়েছিল। এ বার সেটা মাত্রাতিরিক্ত। ফোন তো থামছেই না!' শোনা যাচ্ছে, আপনি নাকি হেয়ার স্টাইলিস্ট খুঁজছেন? হেসে ফেললেন জবি। ব্লন্ড করা চুল ঘিরে রয়েছে তাঁকে। ডার্বির আগে হেয়ারস্টাইল পাল্টে ফেলেছেন। তবে সোনালি নয়, ইচ্ছে ছিল ছাই-ছাই রং করার। 'ভেবেছিলাম তেমনই। কিন্তু এটা করতেই যা সময় লাগছিল, আমি আর ধৈর্য রাখতে পারিনি।' দুটো বড় ম্যাচে পর পর গোল করলেন কী করে? কোচ আলেহান্দ্রো মেনেন্দেসকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। 'যে এগারো জন ম্যাচ খেলতে নামে, তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকা থাকে। যেমন ধরুন রবিবারের ডার্বিটা। চুলোভার উপর ছিল সোনিকে থামানোর ভার। আইদারা রাখবে দিকা-হেনরিকে। আমার উপর নির্দেশ ছিল যেন বল পেলেই ঝড়ের গতিতে উঠি। সেটাই করতে গিয়ে গোল পেয়েছি।' আই লিগের প্রথম ডার্বিতেও সাইড ভলিতে গোল করেছিলেন। ওই দুর্দান্ত গোল নিয়ে এখনও চর্চা। তার মধ্যে আবার হেডে ফ্লিকে করে ফেলেছেন আরও এক চোখধাঁধানো গোল। জবি বললেন, 'ডিকা কর্নারটা তোলার সময়ই জানতাম বলটা কোথায় আসতে পারে। ' বিদেশিদের পিছনে ফেলে এই মুহূর্তে ডার্বিতে যিনি আলোচিত স্ট্রাইকার, সেই জবি দু'বছর আগেও জানতেন না এত কিছু করে ফেলবেন। বাবা জাস্টিনের পেশা সমুদ্রে মাছ ধরা। তিন ভাইয়ের টানাটানির সংসারে চাকরিটাই ছিল স্বস্তির সবচেয়ে বড় জায়গা। কেরালা রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের হয়ে অফিস লিগের একটা ম্যাচ খেলছিলেন জবি। গ্যালারিতে বসে থাকা আলভিটো ডি'কুনহার নজরে পড়ে যান। কেরিয়ারের সেটাই টার্নিং পয়েন্ট। জবির কথায়, 'আলভিটো ভাই না থাকলে আমার ইস্টবেঙ্গলে আসাই হত না। এখানে আসার পর ইস্টবেঙ্গল যে ভাবে পাশে থেকেছে, কখনও ভুলতে পারব না। গত বার সে ভাবে সুযোগ পাইনি। এ বার পুরো জীবনটাই পাল্টে গিয়েছে।' যতই ইস্টবেঙ্গলে সাফল্য পান, বাবা জাস্টিন এখনও তাঁর সব পিছনে ফেলে ফুটবলার হওয়া মেনে নিতে পারেননি। জবি বলছিলেন, 'যখন ইস্টবেঙ্গলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাবা পরিষ্কার বলেছিল, নিশ্চয়তার জীবন ছেড়ে কেন এই সবের দিকে পা বাড়াচ্ছি। এই ক'দিন আগেও বলেছে, ফিরে আয়, না হলে চাকরিটা রাখতে পারবি না।' সোমবার সকালে প্র্যাক্টিসেও জবিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কোচ-ফুটবলাররা। ব্রেন্ডনের জন্মদিনের কেক কাটার পাশাপাশি সমর্থকরা হাজির ছিলেন মিষ্টি নিয়ে। বিকেলে যখন দেখা হল, তখনও জবি জানেন না, চেন্নাই হেরে গিয়েছে রিয়াল কাশ্মীরের বিরুদ্ধে। শুনেই বললেন, 'ওহ্, এটাই তো চেয়েছিলাম। ডার্বি ম্যাচটা আমাদের কাছে খুব চাপের ছিল। হারলে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যেত। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। যে ভাবে হোক আই লিগটা পেতেই হবে।' স্টেইনগান স্টাইলটা নাকি ক্লাবের কথায় করেন। 'ও তো ক্লাব বলেছিল। সোনি ওই একই রকম ভাবে সেলিব্রেট করত। ওকে কাউন্টার করার জন্য হয়তো।' আর রবি-রাতে গোলের পর গোঁফ মোচড়ানো? 'সেঞ্চুরির পর শিখর ধাওয়ানকে ওই রকম করতে দেখেছি। তাই ওই ভাবে সেলিব্রশন করেছি।' জাতীয় টিমে ঢোকার স্বপ্ন দেখা জবি এখন সুনীল-মন্ত্রে বিশ্বাসী। 'তেত্রিশ বছরের একটা ফুটবলার এত সাকসেস কী করে পায়? নিজেকে কঠোর অনুশাসনে রাখতে না পারলে ফুটবলে সাফল্য আসে না। সুনীলভাইকে দেখে শিখছি।' তিরুবনন্তপুরমের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ডার্বির নায়ক। স্বপ্ন তবু তো থেমে থাকে না। ১৩ ম্যাচে পাঁচবার ম্যাচের সেরা হওয়া জবি আই লিগের পোডিয়ামে উঠার স্বপ্নে বুঁদ।
from Eisamay http://bit.ly/2G5JZoY